স্কাউটিং এর মূলনীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে দেশের শিশু-কিশোর ও যুবদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম স্কাউটিং সর্বজন স্বীকৃত। স্কউটিং এর বাস্তবমুখী ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েরা ছোট বেলা থেকেই সঠিক দিক নির্দেশনার ফলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেয়ে থাকে। নিরক্ষর ও মাদকমুক্ত সমাজ, সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে এবং ছিন্ন মানুষের সেবা ও সহযোগিতা করার জন্য স্কাউটরা সমাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে সক্ষম হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে স্কাউটরা নিজেদের তৈরি করার অদশ্য কর্মস্পৃহা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্কাউটস এর স্ট্রাটেজিক প্লান অনুযায়ী ৬টি অগ্রাধিকার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ভলান্টিয়ার লিডার ও প্রফেশনাল স্কাউট এক্সিকিউটিভগণ কাজ করে যাচ্ছেন।
সমগ্র বাংলাদেশের ৬৪টি প্রশাসনিক জেলা, ৫টি মেট্রোপলিটন এলাকা এবং ৪৮৯টি উপজেলায় (নবগঠিত উপজেলাসহ) স্কাউটিং এর সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রোভার, রেলওয়ে, নৌ ও এয়ার এই চারটি বিশেষ অঞ্চল শুধুমাত্র জেলা পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। অঞ্চল সমূহের আওতাভুক্ত প্রশাসনিক জেলা ৬৪টি, ৫টি মেট্রোপলিটান জেলা, ৬৪টি রোভার জেলা, ১৩টি রেলওয়ে জেলা, ৬টি এয়ার জেলা এবং ৬টি নৌ জেলাসহ সর্বমোট ১৫৬টি জেলা স্কাউটস রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্কাউটসের আওতাধীন অঞ্চল এর সংখ্যা ১৩টি।
স্কাউটিং একটি শিক্ষামূলক যুব আন্দোলন। স্কাউটিং এর মাধ্যমে ০৬/২৫ বয়সীদের মুক্তাঙ্গণে বৈচিত্রময় কর্মসূচির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ এর মাধ্যমে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো হয়ে থাকে যা দৈহিক, মানসিক/আবেগিক ,আধ্যাত্মিক, সামাজিক, ও বুদ্ধিমত্তার , উন্নয়ন ঘটিয়ে চরিত্রবান, দক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল আদর্শ নাগরিকরূপে গড়ে তোলার বিশেষ কৌশল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। মূলতঃ প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি সম্পূরক সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম হচ্ছে স্কাউটিং। স্কাউটিং ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে তরুণদের চরিত্রবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বব্যাপী সমাজের চরিত্রগঠনের উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল (বিপি) ইংল্যান্ডে যে আন্দোলনে সুচনা করে কালক্রমে তা দেশে দেশে অভুতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্কাউট আন্দোলন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ও অনুসৃত একটি স্বেচ্ছাসেবী, শিক্ষামূলক, অরাজনৈতিক শিশু-কিশোর ও যুব আন্দোলন। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে যুব সম্প্রদায়কে সুসংগঠিত করে চরিত্র গঠন ও সুনাগরিক সৃষ্টিতে এই আন্দোলন মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। ১৯৯৪ সালে দেশে গার্ল-ইন-স্কাউটিং এর কার্যক্রম শুরুকরা হয়। বর্তমানে বিশ্বে ১৬২টি দেশে স্কাউটং কার্যক্রম চালু আছে যার মধ্যে ৮৪টি দেশে গার্ল-ইন-স্কাউটিং রয়েছে। এসব বিবেচনায় স্কাউটিং আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিক্ষামূলক যুব আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশ স্কাউটিং আন্দোলন: ১৯১১ সালে অবিভক্ত উপমহাদেশে স্কাউট আন্দোলনের সুত্রপাত। আমাদের দেশের স্কাউট আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ স্কাউটস নব উদ্যম ও প্রেরণা নিয়ে অগ্রযাত্রা শুরুকরে। দেশে শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুন-তরুনীদের বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সৎ, চরিত্রবান, কর্মোদ্যোগী, সেবাপরায়ণ এবং সর্বোপরি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্কাউটস নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক অবস্থা ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে দেশ ও জাতি গঠনে স্কাউট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাংগঠনিক অবকাঠামো: বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১১১নং আদেশ বলে ১৯৭২ সালে “বাংলাদেস বয় স্কাউট সমিতি” নামে স্কাউটিং কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৭৮ সালে ১৮ জুন জাতীয় কাউন্সিলের পঞ্চম সভায় বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতির নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় “বাংলাদেশ স্কাউটস”।
জাতীয় কাউন্সিল: জাতীয় কাউন্সিল বাংলাদেশ স্কাউটসের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট এই কাউন্সিলের প্রধান। প্রতি বছর জাতীয় কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের জাতীয় কাউন্সিল সভা বাংলাদেশ স্কাউটসের ৪৩তম (ত্রৈ-বার্ষিক) সাধারণ সভা।
প্রধান জাতীয় কমিশনার: প্রধান জাতীয় কমিশনার বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান নির্বাহী। তাঁকে সহায়তা করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবী, সুযোগ্য ও স্কাউট সেবায় নিবেদিত প্রাণ ২০ জন জাতীয় কমিশনার এবং ৪০ জন জাতীয় উপ কমিশনার রয়েছেন। দেশব্যাপী স্কাউট আন্দোলনের সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ পেশাগত ভাবে প্রশিক্ষিত ৬৯ জন প্রফেশনাল স্কাউট এক্সিকিউটিভ রয়েছেন।
অঞ্চলসমূহ: দেশব্যাপী স্কাউট আন্দোলনের সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামো সুষ্ঠু, সুন্দর ও সমন্বিত ভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্কাউটসকে মোট ১৩টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট অঞ্চল, ময়মনুসংহ অঞ্চল সদর দফতর বিভাগীয় সদরে অবস্থিত এবং বোর্ড ভিত্তিক অঞ্চলের মধ্যে কুমিল্লা অঞ্চলের সদর দফতর কুল্লিায় ও দিনাজপুর অঞ্চলের সদর দফতর দিনাজপুর অবস্থিত। খুলনা অঞ্চলের সদর দফতর যশোরে অবস্থিত। রোভার, রেলওয়ে, নৌ ও এয়ার এই ৪টি বিশেষ অঞ্চলের সদর দফতর ঢাকায় অবস্থিত।
স্কাউটিং এর শাখাসমূহ:
কাব স্কাউটিং: দেশে সর্বত্র স্কাউট আন্দোলন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা স্কাউটসসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যায়, কিন্ডার গার্টেন স্কুল, এবতেদায়ী মাদ্রাসা ও সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ১৯৯৫ সাল থেকে কাবিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ থেকে ১০+ বছর বয়সী বালক বালিকাদের মধ্যে কাবিং এর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীনে “প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পটি ২০১০-২০১৫ সালের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে। প্রকল্পে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
স্কাউটিং: বর্তমানে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার কিশোর-কিশোরী যাদের বয়স ১১ থেকে ১৬+ বছরের মধ্যে তাদেরকে স্কাউটিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আনার ফলে দেশব্যাপী স্কাউটিং এর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় “হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট থ্রু স্কাউটিং” প্রকল্পটি অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্পর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
রোভার স্কাউটিং : দেশের যে সমস্ত তরুন-তরুণী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অথবা যাদের বয়স ১৭ বছর বা তার চেয়ে বেশী, কিস্তু ২৫ বছরের কম তাদেরকে রোভার অঞ্চলের আওতায় এসে দেশব্যাপী রোভারিংয়ের সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে। এছাড়া রেলওয়ে অঞ্চলের চাকরিজীবিদের জন্য ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত রোভার স্কাউট হিসেবে স্কাউটিং করার সুযোগ রয়েছে।
ব্যবস্থাপনা: দেশে স্কাউটিং সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যক্রম যথা ঃ নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, মনিটরিং, মূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকার জাতীয় সদর দফতর থেকে পরিচালিত হয়। জাতীয় সদর দফতরে ১) সংগঠন, ২) প্রোগ্রাম, ৩) প্রশিক্ষণ, ৪) সমাজ উন্নয়ন, ৫) আন্তর্জাতিক, ৬) গবেষণা ও মূল্যায়ন, ৭) জনসংযোগ ও মার্কেটিং, ৮) বিধি, ৯) গার্ল ইন স্কাউটিং, ১০) এডাল্ট রিসোর্স, ১১) সমাজ উন্নয়ন, ১২) এক্সটেনশন স্কাউটিং, ১৩) ফাউন্ডেশন, ১৪) আইসিটি, ১৫) প্রকল্প, ১৬) ভূ-সম্পত্তি, ১৭) অডিট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ১৮) স্পেশাল ইভেন্টস, ১৯) মেম্বারশীপ গ্রোথ, ২০) মেম্বারশীপ রেজিষ্ট্রেশন, ২১) প্রকাশনা, ২২) স্বাস্থ্য ২৩) আইসিটি বিভাগ রয়েছে। প্রতিটি বিভাগের জাতীয় কমিশনার ও জাতীয় উপ কমিশনারবৃন্দ সংশ্লিষ্ট জাতীয় কমিটির সহায়তায় নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্তসমূহ বস্তবায়ন করে থাকেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে একজন সভাপতি, একজন আঞ্চলিক কমিশনার, একজন সম্পাদক, রিজিওনাল ডাইরেক্টর/ডেপুটি ডাইরেক্টর/এ্যাসিসটেন্ট ডাইরেক্টরবৃন্দ, শিক্ষা বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের নেতৃত্বে একযোগে কাজ করে স্কাউট আন্দোলনের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের অবদান রেখে চলেছেন।
তহবিল ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা : শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্থিক মঞ্জুরী থেকে বাংলাদেশ স্কাউটস এর সংস্থাপন ব্যয়ের অংশবিশেষ নির্বাহ করা হয়ে থাকে। ১৫ তলা জাতীয় স্কাউট ভবনের ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় দ্বারা ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্থাপন ব্যয় এবং উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। ইউনিটের সকল পর্যায়ের কাব/স্কাউট/রোভার/এডাল্ট লিডার গনের কাছ থেকে স্কাউট ফি আদায়ের মাধ্যমে ইউনিট থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত স্কাউটিং কার্য ক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া সরকারের স্কাউটিং উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার সাথে পার্টনারশীপের মাধ্যমে স্কাউটিং এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।